একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সকল আসামির খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
বুধবার অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। আপিল বিভাগের কার্যতালিকায়ও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গত ১২ জানুয়ারি, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমান এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অন্যান্য আসামিদের খালাস দেয় হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেছেন।
রায়ে বলা হয়েছে, আইনের ভিত্তিতে মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়নি, ফলে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ। এজন্য বিচারিক আদালতের ডেথ রেফারেন্স নাকচ এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করা হয়েছে
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, "অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি আবদুল হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও ২৫ জন শ্রুতসাক্ষীর জবানবন্দির ভিত্তিতে বিচারিক আদালত এই রায় দিয়েছিল। তবে এই ২৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দির মধ্যে একটির সাথে আরেকটি সমর্থন করেনি। কোনো চাক্ষুস সাক্ষী ছিল না। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনো প্রমাণযোগ্য বা আইনগত মূল্য নেই।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেছেন, "কারণ জীবদ্দশায় তিনি তার স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে গেছেন। এই স্বীকারোক্তি জোর করে নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে। তাছাড়া, মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিটি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা যাথাযথভাবে পরীক্ষা এবং গ্রহণ করা হয়নি।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগের দাবি, এই হামলা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, যার লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা।
হামলার পরদিন, ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট, মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। পরবর্তীতে থানা পুলিশ, ডিবি এবং সিআইডি তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ঘটনার চার বছর পর, ২০০৮ সালের ১১ জুন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির দুটি আলাদা অভিযোগপত্র দেন— একটি হত্যার অভিযোগে এবং অন্যটি বিস্ফোরক আইনে। এই মামলায় জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়।
২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন করে মামলার বিচার শুরু হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে। সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।
এতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ চার দলীয় জোট সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে। দুই মামলায় মোট ৫২ আসামির বিচার শুরু হলেও, অন্য মামলায় তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বিচারিক আদালত মোট ৪৯ আসামির বিচার করেন।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ওই রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব প্রয়াত হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ের পর, ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর, বিচারিক আদালতের রায় প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছে। দণ্ডিতরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল এবং জেল আপিল করেন।
ডেথ রেফারেন্স-আপিলের পেপারবুক প্রস্তুত হলে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে শুনানি শুরু হয়। বিচারপতি সহিদুল করিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তবে, ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে, ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। তার ক্ষমতাচ্যুতির পর বিচার বিভাগে পরিবর্তন আসে। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন, এবং পরবর্তী সময়ে আরও পাঁচজন বিচারপতি পদত্যাগ করেন। নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ১১, ১২ ও ১৫ আগস্টে এখতিয়ার পরিবর্তন করে হাইকোর্টের ৫৪টি বেঞ্চ পুনর্গঠন করেন। বেঞ্চ পুনর্গঠনের পর মামলাটি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে চলে আসে।
গত ৩১ অক্টোবর, এই বেঞ্চে নতুন করে শুনানি শুরু হয় এবং ২৮ নভেম্বর চূড়ান্ত শুনানি শেষে মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে, উচ্চ আদালত সব আসামিকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করে।

0 Comments